• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

খুরুশকুলে চলছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ 

শুঁটকি থেকে আসবে বিপুল ডলার

  • তরিকুল ইসলাম সুমন
  • প্রকাশিত ০৮ মে ২০২৪

কক্সবাজারের খুরুশকুল ইউনিয়নে সরকারি অর্থ্যায়নে শুঁটকি উৎপাদনের জন্য ‘শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপন’ চলছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। প্রকল্পটির কাজ ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছে। প্রকল্পটি শুরু হলে এখান থেকে বছরে দেড় হাজার কোটি টাকার শুঁটকি উৎপাদন হবে। এই শুঁটকি পুরোপুরি রপ্তানি হলে এর অর্থ গিয়ে দাঁড়াবে দ্বিগুণ। সরকারের আশা, এই প্রকল্পের শুঁটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা দেশে আসবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে রূপান্তরের লক্ষ্যে বাস্তুচ্যুত ৪ হাজার ৬০৯টি জেলে পরিবারকে খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পে পুনর্বাসন করা হবে। এসব জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের জন্য শুঁটকি উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়নে এ প্রকল্পের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। প্রয়োজনীয় জনবল সংকট এবং আর্থিক সংস্থান না হওয়ায় নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্পের সকল কাজ শেষ হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ৫০ শতাংশ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২১ সালে ২৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্ব পায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি)।
কক্সবাজার জেলায় শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপন প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান বলেন, বর্তমান সরকার জনবান্ধব। সরকার দেশের উন্নয়নের পাশাপাশি জীবন ও জীবিকায়নের কাজ করছে। কক্সবাজারের উন্নয়নমূলক কাজের জন্য বাস্তুচ্যুত প্রায় ৫ হাজার জেলে পরিবারের বসবাসের জন্য খুরুশকুলে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পে ১৩৯টি ৫ তলা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব জেলে পরিবারের জীবিকার জন্য এখানে শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে। যেখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ১০ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি প্রতি বছর ৭ হাজার ৫৭ টন শুঁটকি উৎপাদন হবে। যার বাণিজ্যিক মূল্য প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। যা দেশীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে আনবে বৈদেশিক মুদ্রাও। এখানেই শেষ নয়, শুঁটকি ব্যবসায়ীদের জন্য থাকবে ৩০০টি স্টোর কাম অফিস।

তিনি আরো বলেন, এই শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপন কাজ যাতে দ্রুত ও নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করা যায় সে জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) চেয়ারম্যান সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বাস্থ্য সম্মতভাবে খুরুশকুল শিল্প এলাকায় শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হবে। আমাদের স্পট বুঝে পেয়ে কাজ শুরু করতে কিছুটা বিলম্ব হওয়ায় আমাদের অগ্রগতি কম হলেও আমাদের কাজ থেমে নেই। আমরা দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য চেষ্টা করছি। যেহেতু বিশাল কর্মযজ্ঞ এ কারণে কিছুটা সময়ও বাড়াতে হতে পারে। এ জন্য আমরা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলছি।

তিনি আরো বলেন, দেশে শুঁটকি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে সরকারের এই প্রকল্প। যা স্থানীয় জেলেদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বীই করবে না। নিজেদের চাহিদা পূরণ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও ভূমিকা পালন করবে।

প্রকল্প এলাকা ঘুরে এবং প্রকল্প পরিচালক প্রকল্পটির পরিচালক মো. শামসুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুরো ৪৫ একর এলাকা জুরেই চলছে কর্মযজ্ঞ। এর মধ্যে ২ হাজার ৫০০ বর্গমিটার আয়তনের অবতরণ শেড নির্মাণ, ১ হাজার ৮৬০ বর্গমিটার আয়তনের চারতলা বিশিষ্ট ল্যাব, অফিস, প্রশিক্ষণকেন্দ্র কাম ডরমেটরি, ১০০ টন ক্ষমতা সম্পন্ন কোল্ড স্টোরেজ (৪ চেম্বার বিশিষ্ট)। এ ছাড়াও ২টি ওয়ে ব্রিজ এবং ৩টি পন্টুন বা গ্যাংওয়ে তৈরি, ৩৫০টি গ্রিন হাউস বেইজড মেকানিক্যাল ড্রায়ার স্থাপন করা হচ্ছে যেগুলো দেখভালের দায়িত্ব পালন করবে পুনর্বাসিত জেলে ও ব্যবসায়ী সমন্বিত কমিটি। এসব ড্রায়ারের মাধ্যমে প্রতি তিনদিনে ১৫৫ কেজি শুঁটকি উৎপাদন হবে এবং ৩০টি মেকানিক্যাল ড্রায়ার স্থাপনের কাজ চলছে যা দেখভাল করবে বিএফডিসি। এ ড্রায়ারের মাধ্যমে প্রতিদিন ৩০০ কোজি শুঁটকি মাছ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। ব্যবসায়ীদের জন্য ৩০০টি স্টোর কাম অফিস ঘর, শুঁটকি বিক্রয়কেন্দ্র ও সংরক্ষণাগার নির্মাণ চলছে (এর মধ্যে বড় ৫০টি, ছোট ১৫০টি এবং মিডিয়াম ১০০টি ঘর রয়েছে)। ১০টি টয়লেট জোন নির্মাণ, প্যাকেজিং ফ্যাক্টরি স্থাপন, ইটিপি, এসটিপি ও ডব্লিউটিপি নির্মাণ, ৩টি জেনারেটরসহ ১টি বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন স্থাপন ও ৩টি আরসিসি জেটি নির্মাণকাজ চলমান।

তিনি আরো বলেন, দেশের শুঁটকির আন্তর্জাতিক মান ও সংরক্ষণের জন্য পারমানবিক শক্তি কমিশন আমাদের সঙ্গে কাজ করবে। তারা ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় কাজ শুরু করছে। প্রকল্প এলাকায় তাদের জন্যও একটি অফিস বরাদ্দের কাজ চলমান রয়েছে।

প্রকল্পের কাজের সঙ্গে যুক্ত প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানকার এই পরিবেশে কাজ করা খুবই চ্যালেঞ্জিং। প্রকল্প শুরু থেকেই নানা চ্যালেঞ্জের মুখে কাজ করতে হচ্ছে। অফিস ভবন নির্মাণ শেষ হয়েছে। এখন অবতরণ শেডের পাইলিং চলছে, ১০টি টয়লেট জোন আর ফিশ ড্রায়ারের নির্মাণের কাজ চলছে। গুদাম তৈরির কাজ চলছে। আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে অন্যতম হলো পানির সংকট। নলকূপে সব সময় পানি পাওয়া যায় না। মাটির নিচের জলাধারগুলো বা বেসিনগুলোতে পানি পাওয়া যায় না। ইতোমধ্যে অনকে নলকূপ বসানো হয়েছে। সীমানা প্রাচীর না থাকায় প্রায় সময়েই মালামাল চুরি হয়ে যাচ্ছে। নেই কোনো রাস্তা। বৃষ্টি হলেই কাজ করা কষ্ট কর হয়ে ওঠে।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, গ্রিন হাউস বেইজড মেকানিক্যাল ড্রায়ার এবং মেকানিক্যাল ড্রায়ার স্থাপনের মাধ্যমে প্রতি বছর গড়ে ৭ হাজার ৭৫ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদন করা হবে। এ জন্য প্রায় ৩৬ হাজার মেট্রিক টন কাঁচা মাছ প্রয়োজন হবে। উৎপাদিত শুঁটকির বাণিজ্যিক মূল্য হবে প্রায় ১ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা (প্রতি কেজি ২০০০ টাকা করে)। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ বাজারের চেয়ে রপ্তানির দিকে জোড় দেওয়া হবে।

প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতির বিষয়ে প্রকল্পটির পরিচালক মো. শামসুজ্জামান আরো বলেন, আমরা কাজ শুরু করেছি গত আগস্ট থেকে। ২০২১ সালে প্রকল্প অনুমোদন পেলেও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প এরিয়া বুঝে পেতে দেরি হয়েছে। আমাদের কয়েকটি টেন্ডার বাদে অধিকাংশই সম্পন্ন হয়েছে। কাজ শুরু করতেই দুই বছর দেরি হয়েছে। তাই আমাদের আরও এক বছর লাগবে কাজ শেষ করতে। আর কয়েকটি টেন্ডার বাকি আছে রেট শিডিউল বাড়ায় সেগুলোও দিতে সমস্যা হচ্ছে। আরও কিছু কাজ যুক্ত হবে। এছাড়া দেশে এবং দেশের বাইরে শুঁটকির চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে সরকারের এই প্রকল্প। এছাড়াও মাছের বর্জ্য ব্যবহার করে ফিশ মিল এবং মাছের তেলের অয়েল মিল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশ থেকে প্রায় ২৫ লাখ ৪৫ হাজার ৫১৪ মার্কিন ডলারের সমমূল্যের শুঁটকি রপ্তানি হয়েছে। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ প্রায় ২৮ কোটি টাকা (প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ১১০ টাকা হিসাবে)। এর মধ্যে শুধু ডিসেম্বর মাসেই রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১৪ লাখ ২৭ হাজার ডলারের সমমূল্যের শুঁটকি। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে ৪৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার মূল্যের শুঁটকি। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুঁটকি রপ্তানি ২৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ কমে ৩১ লাখ ৭০ হাজার ডলারে ঠেকেছে। বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি শুঁটকি রপ্তানি হয়েছে ভারতে। দেশটিতে ২৫ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৯ ডলার মূল্যের শুঁটকি রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি হয়েছে ৬ হাজার ৭০৮ ডলার মূল্যের বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া শুঁটকির বড় অংশই গেছে হংকং, সিঙ্গাপুর, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ডে। আস্ত শুঁটকির পাশাপাশি রপ্তানি হয় মাছের বিভিন্ন অংশবিশেষ কেটে তৈরি করা শুঁটকিও। এর মধ্যে রয়েছে লেজ, পাখনা ও অন্ত্র। এসব শুঁটকি আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে উৎপাদিত মাছের অন্তত ১৫ শতাংশ শুকিয়ে শুঁটকিতে রূপান্তর করা হয়। মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে সমুদ্র উপকূল ও অভ্যন্তরীণ জলাধার থেকে প্রায় ৪৭ লাখ ৫৭ হাজার টন মৎস্য আহরিত হয়েছে। তার মধ্য থেকে ওই বছর ৭ লাখ টনের বেশি মাছ শুঁটকি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে।

শুঁটকি ব্যবসায়ীরা জানান, দেশের শুঁটকি উৎপাদিত হয়। এসব মহালে প্রচলিত পদ্ধতিতে কাঁচামাছ রোদে শুকিয়ে শুঁটকি বানানো হয়। তবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) উদ্ভাবিত ‘ফিস ড্রায়ার’ ব্যবহার করে উৎপাদিত শুঁটকি স্বাস্থ্যসম্মত।

প্রযুক্তিগতভাবে বিএফআরআই ফিস ড্রায়ারের মাধ্যমে যেকোনো প্রজাতির মাছ শুঁটকি করা যায়। মশা-মাছি ও কীট-পতঙ্গ নিরোধক ডায়িং হাউসে প্রাকৃতিক সূর্র্যের আলো ও তাপ নিয়ন্ত্রণ করে মাছ আদ্রতামুক্ত করা হয়। দেশে কক্সবাজারের নাজিরারটেক, সোনাদিয়ার চর, মহেশখালী, চট্টগ্রাম নগরের কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী এলাকা, আনোয়ারা উপজেলা, সুন্দরবনের দুবলার চর, সুনামগঞ্জের ইব্রাহীমপুরসহ বিভিন্ন উপকূলবর্তী এলাকায় প্রায় ২৫ প্রজাতির মাছের শুঁটকি তৈরি করা হয়। এর মধ্যে রূপচাঁদা, ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্টা ও পোয়া অন্যতম। এছাড়াও চিংড়ি, ভোল, মেদসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছেরও রয়েছে অনেক চাহিদা। এছাড়া এখানকার শুঁটকি, মাছের গুঁড়ো সারাদেশে পোলট্রি ফার্ম ও ফিস-ফিডের জন্য সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads